Friday 8 June 2012

আমার যত সিনেমা - ২


আমি সব কাজে লেট লতিফা। সিনেমাও তার ব্যতিক্রম কিছু না। আমি জানি যে সিনেমাগুলোর কথা আমি বলবো তার বেশিরভাগই ইতিমধ্যে সবার কয়েক দফা দেখা হয়ে গেছে, তবুও সিনেমাগুলো দেখে আমার কি অনুভূতি হয়েছে তাই লিখবো।
এক মুঠো ছবিঃ রুপা গাঙ্গুলী’র প্রোডাকশনের পরিবেশনা এটি। হিন্দি দশ কাহানীয়া ছবির মতো ছয়টি ছোট গল্প নিয়ে সিনেমাটি বানানো। জন্মদিন, পঙখীরাজ, তপন বাবু, রাগুনবাবুর গল্প, তারপর ভালবাসা আর প্রোগ্রেস রিপোর্ট। তারপর ভালবাসা আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে। খ্যাতি কিংবা ব্যস্ত জীবনের কারণে আমরা কতোজনকে তুচ্ছ করি, কতো কিছুকে তুচ্ছ করি। কোন দুর্ঘটনা কিন্তু জীবনটাকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। সেরকম, একজন খ্যাতিমান ব্যস্ত অভিনেত্রী কি করে এক দুর্ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়েন, তার অসাধারণ গল্পটি উঠে এসেছে। দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন রুপা এখানে। তার অতি অভিনয়ের যে একটা বদভ্যাস ছিলো, সেটা এখানে অন্তত আসেনি। নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কেউ কেউ এই সিনেমাটা দেখতে পারেন। পঙখীরাজ সিনেমাটার হৃদয়বিদারক পরিনতি, আজকালকার ঢাকাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়। বাস্তব হয়তো কিন্তু মন মানতে চায় না। একটি ছোট চায়ের দোকান চালায় মেয়েটি আর স্বপ্ন দেখে একদিন তার সব কষ্ট শেষ হবে আর সে হবে সোকলড ভদ্রলোক। তার চায়ের দোকানের সামনে দিয়েই তার স্বপ্নের রাজকন্যা রোজ অফিসে যায়। কিন্তু বাস্তবের আঘাতে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো। রাগুনবাবুর গল্পটিও অতি বাস্তব। সহ্য করলে যে সামনের লোকটির অন্যায় একসময় বেপোরোয়া হয়ে উঠতে পারে তারই বাস্তব ইতিহাস এটি। বাকিগুলো আপনারা দেখে নিবেন।
ইচ্ছেঃ সুচিত্রা ভটাচার্যের উপন্যাস থেকে করা এই সিনেমাটি। একজন ভাগ্য বিড়ম্বিত উচ্চাকাংখী মায়ের গল্প। মায়ের হাতে নিষ্পেষিত হতে থাকা, শেষে কিছুটা জেদের বশে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলা ছেলের গল্প। সিনেমাটিতে কিছু কিছু দৃশ্য আছে যা আমাদের টিপিক্যাল বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজকে উপস্থাপন করে। যেমন দুই কাজিনের মধ্যে সাধারণ জ্ঞানের লড়াই আর সাথে মায়েদের আর বাবাদের মুখোভাব। সন্তানের ক্যারিয়ার, প্রেম সবকিছুতে মায়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ। অসহায় সন্তানের নিষ্ফল মনোবেদনা বার বার ফিরে এসেছে। একবার শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যাবে না।
রঞ্জনা আমি আর আসবো নাঃ ছোটবেলা থেকেই আমি দেখেছি কারো পরামর্শে কিংবা উপদেশে সিনেমা দেখলে সেটা আমার ঠিক হজম হয় না। তখন আমরা স্কুলে পড়ি, বলিউড মুভির পোকা। কোন একটা সিনেমা দেখে, তার গান শুনে আমরা হাওয়ায় ভাসছি। এমন এক দুপুরে আমি আর চাচাতো বোন গেলাম, ভিডিও ক্লাবে সিনেমা আনতে। লোকটাকে দুই বোনে ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম, খুউউউব রোমান্টিক একটা হিন্দী ছবি দিতে। তিনি দিলেন সানি দেউলের “ডাকাইত”। আমরা দুই বোনে সারা দুপুর সেই সিনেমা দেখলাম আর খুঁজলাম এই বুঝি রোমান্স আসলো এই বুঝি রোমান্স আসলো। এ রকম ডাকাইত অনেকবার আমাদের ওপরে গছানো হয়েছে। রঞ্জনা আমি আর আসবো না ও আমার কাছে সেই ক্যাটাগরীরই লেগেছে। অসাধারণ গান কিংবা গল্প কোনটাই লাগেনি। আর অঞ্জন দত্তের গান শুনে মনে যে ছবি আঁকা ছিল, সিনেমা দেখে সেটা চিরতরে ধুয়ে গেছে। সেজন্যই হয়তো কবি বলেছিলেন, মোষ্ট বিউটিফুল থিংস কানট বী সীন অর ইভেন চাটড। কবি আগেই অভিজ্ঞ ছিলেন।
বেডরুমঃ আধুনিক কালের বেশ আলোচিত সিনেমা এটি। অনেকের কাছেই বেশ প্রশংসা শুনলাম সিনেমাটির। আমার কাছে বেশ গতানুগতিক লেগেছে। এর দুটো কারণ থাকতে পারে, সময়ের আধুনিকতার রেসে আমি পিছিয়ে পড়েছি কিংবা সময় এগিয়ে গেছে। এতো উচ্ছৃখংল জীবন, যা ইচ্ছে তা করা কিংবা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত করা, এসবে এখনো চোখ মন অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। শুধু বুঝিনি সিনেমার নাম কেন বেডরুম হলো। যেকোন টাইপ নাম হতেই পারতো দ্যান বেডরুম। বানিজ্যক চিন্তা থেকে নাকি কে জানে?
শ্বেত পাথরের থালাঃ অনেক আগে ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম, বাবার সাথে বসে। পরিবেশের কারণেই হোক কিংবা গল্প বা সিনেমার কারণেই হোক, সিনেমাটি আমার মগজে আজো দাগ কেটে বসে আছে। অপর্না সেন আর সব্যসাচী চক্রবর্তী, ঋতুপর্না সেনগুপ্ত আর দীপঙ্কর রায় অভিনিত সিনেমাটি। নতুন প্রজন্ম যারা দেখেনি সিনেমাটি তারা দেখে নিতে পারে। ভাল লাগবেই, বিফলে মূল্য ফেরত। ১৯৯২ এর ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছে সিনেমাটি। বানী বসুর লেখা উপন্যাস থেকে এ সিনেমাটি বানিয়েছেন প্রভাত রায়। একটি আধুনিক শিক্ষিত মেয়ের একটি সনাতন পরিবারে বিয়ে হয়। বিয়ের পর ভালই চলছিল গোঁজামিল দিয়ে। হঠাৎ স্বামী মারা গেলে তার বৈধব্য জীবন আর আত্মসম্মানের মধ্যে শুরু হয় চিরদিনের সেই প্রভু – সামন্ত খেলা শ্বশুরবাড়ির সাথে। শেষে ছেলে নিয়ে বাধ্য হয়ে আলাদা হয়ে যান। অনেক কিছু সহ্য করে একা ছেলে মানুষ করলেও, ছেলেও পরে মায়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটা হলো খুব ছোট করে দেয়া সিনেমার বিবরণ।
পাদটিকাঃ আজকাল মাঝে মাঝে বাসাটা একটু স্থিতিতে থাকে। সন্ধ্যাবেলা মা মেয়ে এক সাথে বসি আগের মতো। এটা আমাদের প্রিয় একটি জিনিস। একই কম্বলের নীচে দুজন জড়াজড়ি করে বসে ল্যাপটপে ফেসবুকিং করি, সিনেমা দেখি। কুংফু পান্ডা, স্নিউচে, স্পঞ্জ বব, লোলেক পোলেক কিংবা ভূতের ভবিষ্যত। আরো অনেক নাটক কিংবা সিনেমা। আজকাল লক্ষ্য করি আমার নয় বছরের মেঘ, দুষ্ট – মিষ্টি দৃশ্যে লজ্জা পায়। সে তখন কোক আনতে যায়, চিপস আনতে যায়, আইসক্রীম নিয়ে আসে। কিংবা চোখ বন্ধ করে, মুখ ফিরিয়ে রেখে হাসে। ছোটবেলায় মা – বাবাকে ফাঁকি দিতাম, ভাবতাম বুঝে না। আজ জানি জেনে শুনে হাসি মুখেই তারা এই ফাঁকি মেনে নিতেন। এখন এও উপলব্ধি করলাম, কখন মেয়েকে কোক আনতে পাঠাই আর চিপস আনতে পাঠাই তা মেয়েও বুঝে গেছে। আমি শুধু যে রামে ছিলাম সেই রামেই আছি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ রাসেল আশরাফ ছেলেটা আমার অফিস – বাসা, বাসা – অফিস মার্কা বৈচিত্রহীন প্রবাস জীবনে প্রায়ই একটু আনন্দের ছোঁয়া রেখে যায়। আপা, এই ফিল্ম কিংবা নাটকটা দেইখেন। কিংবা গানটা শুনেন। আর আমার সিনেমা, সফটওয়্যার, গান যেকোন দরকারে একটু নক করলেই হলো। দরকার হলে রাত জেগে কাজ করে দিবে। কোনদিন সামনে থেকে না দেখা এই ছেলেটা অন্য দেশে থেকেও আমার দৈন্দদিন জীবনে একজন পারিবারিক সদস্য। সুখ আমার কপালে সয় না। পুলাটা বিয়ে করতেছে। কোন ডাইনি আমার এই ভাইকে কেড়ে নিচ্ছে। বিয়ের পর জীবন বদলে যাবে। ব্যস্ততা বদলে যাবে। হয়তো এই টুক টুক করে দেয়া লিঙ্কগুলো আর ফেসবুকের ম্যসেজ বক্সের ওপরে লাল টিপ হয়ে জ্বলবে না। তবুও দুয়া করি পুলার জীবনটা সুখে কাটুক। দিল্লী কা লাড্ডু খেয়েই গান করুক, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
তানবীরা
০৬/০৯/২০১২