ভারতীয়দের সাথে নাচ, গানের কারণে অনেকদিনের
মেলামেশা সাজিয়াদের। ওদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আধার হলো ধর্মীয় উৎসব, দিওয়ালি, হোলি, সরস্বতী পূজা কিংবা দুর্গাপূজা ইত্যাদি। নাচগান, খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি সামাজিকতারও
একটা মিলনমেলা এসব।
ক’দিন আগে হোলির অনুষ্ঠান হলো, বসন্তের উৎসব,
বাংলায় যেটাকে ‘দোল’ বলা হয়। অনুষ্ঠানের বিরতির মাঝে একসাথে খেতে বসেছে সব মেয়েরা
গোল হয়ে, সেখানে পূজা উপাসনা নিয়ে কথার এক পর্যায়ে, কথা হচ্ছিলো ‘কন্যা পূজা’
নিয়ে। যারা বাঙালি নয়, তারা ‘কুমারী
পূজা’-কে ‘কন্যা পূজা’ বলে। চোখ গোল গোল করে বেশ অনেকেই বলে যাচ্ছে, এসব
ট্র্যাডিশান সারা পৃথিবীতে শুধু ভারতেই আছে। পৃথিবীর আর কোথাও মেয়েদের এমন সম্মান
দেখিয়ে পূজা করার রীতি নেই। আমাদের নিজেদের বাচ্চাদের এগুলো শেখানো উচি, তবেই না
তারা জানবে আমাদের মূল কোথায়, কোন সমাজ-সংস্কৃতি থেকে আমরা এসেছি।
‘কন্যা পূজা’ হয়ে থাকে দশেরা কিংবা নবমীর
সময়টাতে, দিওয়ালীর আগে। সাধারণত দুই থেকে দশ বছর বয়সী নয়টি মেয়েকে এই পূজা দেয়া হয়
এক এক বাড়িতে আলাদা করে। তাতে একই পাড়ার এক মেয়ে এক সিজনে পাঁচ বাড়িতেও কন্যা পূজা পেতে পারে। অবাঙালি ভারতীয়েরা এদেরকে বাড়িতে
ডেকে পূজার সাথে পা ধুইয়ে দিয়ে ভাল করে খাইয়ে দাইয়ে, নগদ পয়সা, নতুন কাপড় ইত্যাদি
উপহার দেন। বয়সের ব্যাপারটা এখানে লক্ষণীয় কারণ ‘পিরিয়ড’ হয়ে
গেলে বা কন্যা ঋতুমতমী হলে সে আর কন্যা পূজা
পাবে না। পিরিয়ড হওয়ার সাথে কুমারীত্বের সম্পর্কটা অনেকটা এক সমান্তারালে দেখে
নিয়ে ওখানে পিরিয়ড হয়ে যাওয়া কুমারী মেয়েরও পূজা স্টপ, কারণ পূজা একটা পবিত্র
ব্যাপার আর পিরিয়ড হয়ে গেলে হয়তো মেয়েরা আর পবিত্র মানুষ না। অবশ্য তাতে মেয়েরা
কোন অসম্মান দেখে কিনা কিংবা তাদের কোন
খারাপ লাগা আছে কিনা সেটা দৃশ্যমান
নয়। বরং যা পেয়েছে তাই বা কম কী ভেবে নিয়ে তৃপ্ত!
এই কন্যা পূজাকে জীবনের বিরাট সম্মান ধরে নিয়ে
যখন অনেকেই সেখানে গর্বিত মুখে ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীর সম্মান বাখানা করছিলো ঠিক তার
কিছুদিন আগেই বিবিসিতে “ইন্ডিয়াস ডটার–নির্ভায়া” নিয়ে তোলপাড় হয়েছে, ইন্ডিয়াতে
ভিডিওটা ব্যান করা হয়েছে।
ভিডিওটাতে অপরাধীদের ডিফেন্ড-করা উকিল দাম্ভিক ভাষায় বলেছে, ভাল
মেয়েরা এতো রাতে তার বন্ধুর সাথে বাইরে বের হয় না। আসলে ভাল মেয়েরা একা বেরই হয়
না, বের হলে সাথে দাদি, মা, ফুপু কেউ না
কেউ থাকবে দিনের বেলাতে আর রাতে তো ভদ্র মেয়েদের বাড়ি থেকেই বের হওয়ার প্রশ্নই আসে
না।
অপরাধী নিজে সাক্ষাৎকার দিয়েছে, আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ধর্ষিতাদের জন্যে আরো বিপদ ডেকে আনা হলো।
এরপর ধর্ষণ করে সাথে সাথে খুন করে ফেলবে কেউ আর
অপরাধের চিহ্ন রাখবে না। এই মেয়েটা যদি ধর্ষণের সময় বাধা না-দিতো তাহলে একেও এতো অত্যাচার করা
হতো না। ধর্ষণের সময় মেয়েদের বাধা
দেয়া উচিত নয়, চুপচাপ মেনে নেয়া উচিত।
এ-মানসিকতা যাদের, তারা কন্যাকে পূজা করে,
সম্মানের চোখে দেখে, তাও মেনে নিতে হবে? এরপরেও মেয়েরাই পূজিত হওয়ার গর্ব করে, তাও
ভারতে? ইউরোপে মেয়েদের পূজা হয় না কিন্তু ধর্ষণের জন্যে তার জামা কাপড় কিংবা তার চরিত্রের প্রতি
কেউ আঙ্গুল তুলে না। তারা যখন ইচ্ছে তখনই বাইরে যেতে পারে।
তাতে ভাল বা মন্দ কিছু থাকে না। কী ক্ষতি হবে ইউরোপে বসে আমাদের মেয়েদের কন্যা
পূজার সংস্কৃতি না জানলে?
‘কন্যা পূজা’-র আরেক
পর্ব হলো, মেয়েদের প্রথম পিরিয়ড হলে বিবাহিতা নিকটাত্মীয়াদের যাদের বাচ্চা আছে, তাদের ডাকা হয়, বিশেষ
করে পুত্র সন্তানের জননীদের, সদ্য ঋতুমতী মেয়েকে আশীর্বাদ
দিতে। মেয়েটিও যেনো এমন উর্বরা হয়, নির্বিঘ্নে যেনো তার সন্তান হয়ে যায় তবে পূজার
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যটা থাকে, পুত্র সন্তান হওয়ার দিকে। যে-সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরে
একটি মেয়ের সম্মান নির্ধারণ করা হয় ‘কুমারীত্ব’
আর ‘পুত্রসন্তান উৎপাদনের’ মাধ্যমে, সে-সংস্কৃতি নিয়ে যখন ভিকটিমরাই গর্বিত থাকে, তখন
চুপচাপ শুনে যাওয়া ছাড়া জিজ্ঞেস করার কিছু থাকে না। এমনকি,
এরকম শাস্ত্রবচনও আছে “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা”, মানে, স্ত্রীসঙ্গম করবে শুধু
পুত্রজন্ম দেওয়ার জন্যে। স্ত্রীর জন্মই পুত্রজন্ম দিয়ে নিজের নারীজন্ম সার্থক
করতে, একটি চাষের ক্ষেত যেন সে। মনুসংহিতায় বলছে, নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে
স্বামীর ও বার্ধক্যে পুত্রের অধীন থাকবে, ন নারী স্বতন্ত্রমর্হতি, নারীদের
স্বাধীনতার কোনো সুযোগই নেই। স্বামীপুত্রবতী নারীর নাম বীরা, কন্যাবতী নারীর নাম
কী? ইতিহাস বা ভাষা এখানে নীরব। নারীর আবার দাম কী, উৎপাদিকা শক্তি হওয়া ছাড়া?
ডাক্তার হয়েছো কিংবা কেমিস্ট, একাউন্টেন্ট কিংবা
ইঞ্জিনিয়ার তা নিয়ে গর্বিত নও, গর্বিত তুমি পূজা পাওয়ার কারণে, কেন মেয়ে? নিজের
ইচ্ছেয় তো নারীলিঙ্গ তুমি নির্ধারন করো নি! আর কুমারী
পূজা কি জীবনের সব অন্যান্য অপ্রাপ্তি, অসম্মান,
অসম অধিকার ভুলিয়ে দেয়, না দিতে পারে?
যারা কুমারী পূজা করতো আবার তারাই নারীদের পতির
মৃত্যুর পর ঠেলে তুলতো চিতায়, শাস্ত্র
থেকে উদ্ধৃতি দিতো, যে-রমণী পতির মৃত্যুর পর পতির সাথে অনুমৃতা হয়, সে তার পতির
দেহে যতো লোম, তত বৎসর স্বর্গবাস করে, বহুবিবাহ দিয়ে কুলীনদের বংশ উদ্ধার করতো, ঋতুমতী অবিবাহিতা বালিকাদের
পিতা দেখলে তাঁর জীবন্তে নরকবাস হয় বলে শাস্ত্রে জানাতো, বালবিধবাদের আমৃত্যু কষ্টকর যন্ত্রণাচিহ্ন
ধারণ করতে বাধ্য করতো দেহে ও মনে, বিনা অপরাধেই, তাদের এসব পূজোপাঠ কি আসলেই নারীর প্রতি সম্মান কোনো দিকে,
কোনো ভাবে? কিংবা, এতো অত্যাচার করে কি আসলেই নারীর প্রতি সম্মান জানানোটা ব্যঙ্গ
কিংবা ভন্ডামো ছাড়া আর কিছু বলে মানা যায়? যে-দেশে
নারীভ্রূণবধ এখনও নিত্যকর্ম কিংবা এমনকি নারী শিশুহত্যাও, সেই দেশ যখন নারীর সম্মান
নিয়ে গর্ববোধে আপ্লুত ও আচ্ছন্ন হয়, তখন জনমদুখিনী সীতার মতোই বলতে ইচ্ছে করে, “হে
মা ধরিত্রী, দ্বিধা হও, আমি ভেতরে প্রবেশ করি।”
কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত
হয় তবে মতান্তরে নবমী পূজার দিনও এ-পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে।
শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে বধ করার মধ্য
দিয়ে থেকে। গল্পে বর্ণিত রয়েছে, কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ
মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সেসব দেবগণের আবেদনে সাড়া দিযে় দেবী
পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন
শুরু হয়।
কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও
পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে-ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়
ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা
নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা
করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী
ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত আছে, এ-ভাবনায় ভাবিত
হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
কুমারী
পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা
বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়, এমনকি
বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত।
এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেযে়র পূজা করা যায়। বয়সের
ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়।
·
এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা
·
দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী
·
তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি
·
চার বছরের কন্যা — কালিকা
·
পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা
·
ছয় বছরের কন্যা — উমা
·
সাত বছরের কন্যা — মালিনী
·
আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা
·
নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা
·
দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা
·
এগারো বছরের কন্যা — রুদ্রাণী
·
বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী
·
তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী
·
চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনায়িকা
·
পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা
·
ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা
প্রসঙ্গত নববর্ষে যা ঘটে গেলো বাংলাদেশে, শুধু ঢাকাতে নয়, চট্রগ্রামেও এ
ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তাতে ইসলাম ধর্মে নারীর সম্মান নিয়ে আর নাই লিখি। ঘটনা ঘটিয়েই
বেজন্মারা ক্ষান্ত হয়নি ভিডিও করে সোস্যাল মিডিয়াতে প্রচার করছে, নতুন বছরের মতো
বির্ধমীয় ব্যাপারে মুসলমান মেয়েরা ঘরের বাইরে বের হলে তাদের এই হাল করা হবে। অনেক
পুরুষই বীর দর্পে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তাদের মা বোন বাড়ি থেকে বের হয়নি, অসম্মানিত
হয়নি। যারা ঘষা খেতে চায়, তারাই বের হয়! কথা হলো, বিধর্মী ব্যাপারে ঈমানদার
পুরুষরা বাড়ি বসে থাকে না কেন? তারা কেন বের হয়! স্বর্গে শুধু মেয়েদের যেতে হবে
কেন? আঙ্গুর বেদানায় পুরুষদের লোভ নেই!